প্রেম-ভালোবাসার গল্প | গল্প নাম্বার - ১

জানুয়ারীর এক ঠান্ডা বিকেলের কথা । আমি বসে ছিলাম শহরের নির্জন অংশের ছোট্ট একটা কফিশপে । এক হাতে ছিল এক মগ এক্সপ্রেসো কফি, আরেক হাতে একটা রগরগে চাররঙের ম্যাগাজিন । শীতটা সে বছর একটু বেশিই পড়েছিল, পশমের মোটা পুলওভার, ধোয়া ওঠা এক্সপ্রেসো কফি আর ম্যাগাজিনের পাতার উত্তেজক বিদেশী নায়িকাদের সাংঘাতিক নাভি-পেট বুক কিছুই ওম দিচ্ছিল না । জানুয়ারীর হিম রক্তের ভেতরঢুকে পড়ে পুরো শরীর জুড়ে একধরণের শিরশিরানো অনুভূতি জাগাচ্ছিল ।এরকম এক শীতের বিকেলে তার সাথে প্রথম পরিচয় । সেও এসেছিল কফি খেতে । বসেছিল আমার ঠিক সামনের টেবিলে । আশ্চর্যের ব্যাপার এত কাছে থাকা এবং যথেষ্ট সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও তারদিকে আমার চোখ পড়েনি ।সে যখন ধীর পায়ে আমার টেবিলে এসে বলেছিল, " আপনি খুব চমত্‍কার অভিনয় করেন ।" তখনই আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম । তার মাথাভর্তি ছিল আলুথালু বাদামি রঙের চুল, খাড়া নাক,গভীর গভীর দুটো চোখ, পাতলা ঠোঁট, গায়ে চকোলেট রঙা একটামেয়েদের জ্যাকেট আর গলায় প্যাচানো কাশফুলের মতো শাদা একটা উলের ওড়না ।আমি কিছুটা থতমত খেয়ে তাকে বসতে বলেছিলাম । বসতে বসতে মিষ্টি এক চিলতে হাসি হেসে সে আবার বলেছিল, "আপনি খুব ভালো থিয়েটার করেন।" ক'দিন আগে স্থানীয় একটা সরকারী কলেজে আমরা একটা নাটক করেছিলাম, এই মেয়ে সম্ভবত ঐকলেজের ছাত্রী । আমি একটু লজ্জার হাসি হেসে বলেছিলাম, "ঐ আর কি ।"
এই ভাবে শুরু হলো... । আমি সেদিন জোর করে তার কফির বিলটা দিয়ে দিয়েছিলাম, আর সে পার্চ থেকে একটা গোলাপী নোটপ্যাড বের করে টুকে নিয়েছিল আমার মোবাইল নাম্বারটা ।তারপর থেকে মোবাইল ফোনে টুকটাক কথা, এস এম এস, মাঝে মাঝে কফিশপে আড্ডা, তারও পরে, যাহয় আর কি, আমরা প্রেমে পড়ে গেলাম ।মেয়েদের ক্ষেত্রে একটা অভিযোগ প্রায়ই আনা হয়, তারা নাকি ছেলেদের টাকা-পয়সাটাই আসলে পছন্দ করে । আমিও এরকমই ভাবতাম, কিন্তু ও সামান্য কফি ছাড়া আর কিছুই খেতে চাইতো না, আর এটা ওটা কিনে দিলে তো রীতিমতো ফণা তুলতো, এতে নাকি ওর ইগোতে আঘাত করা হয় । 
ও পছন্দ করতো হাত ধরাধরি করে রেল লাইন বা নদীর ভেজা পাড় ধরে খালি পায়ে হাঁটতে । আর হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই একটা অবিশ্বাস্য কাজ করত : ইনিয়ে বিনিয়ে আমার চেহারার প্রশংসা করত । প্রথমে পাত্তা দিতাম না, ভাবতাম মজা করছে, কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝলাম, কোন এক বিচিত্র কারণে আমার কালো কার্টুনের মতো চেহারাটা ওর মনে ধরে গেছে । বলতে লজ্জা নেই, তারপর থেকে আমি নিজেকে আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা আরম্ভ করলাম । এবং আশ্চর্যের ব্যাপার ক'দিনের ভেতর প্রথমবারের মতো মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ জাগলো : আমি মনে হয় দেখতে ভালোই ।সেই থেকে নিজের চেহারার যত্ন আত্তি শুরু করে দিলাম । কসমেটিকের দোকান থেকে ফেসওয়াশ, ফেয়ারনেস ক্রিম, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার কিনে আনলাম । চেহারার সাথে মানানসই দেখে নতুল কায়দায় চুল রেখে দিলাম । দু'দিন পর পর ফোম শেভ করতে লাগলাম ।আমার মনে হলো, শুধু চেহারা ভালো করলে হবে না সাথে শরীরটাও যুতসই করা দরকার । ভর্তি হয়ে গেলাম শহরের অভিজাত একটা জিমে । 
পাল্টে ফেললাম দৈনন্দিন খাবারের মেনু । বয়স, উচ্চতা আর ওজনের কথা মাথায় রেখে ক্যালোরি মেপে মেপে খাওয়ার অভ্যাস করলাম ।একমাসের ভেতর আমার শরীর চেহারা পোশাক আশাকে এক অভাবনীয় পরিবর্তন আসল । কী বলব, নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে গেলাম ।ওর সাথে ঘুরতে বেরোই, একথা সেকথার পর ও পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলে,তুমি দিনকে দিন আরো বেশী সুন্দর হচ্ছ । আমি মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়াই আর বাসায় যেয়েঅমনি আয়নার সামনে দাঁড়াই । এইভাবে নিজের প্রতি আমার ভালোবাসা প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়তে লাগল ।আরো কিছুদিন পর, যে দিন আমি আবিষ্কার করলাম, পৃথিবীর যে কোন কিছুর চেয়ে আমি আমার যত্নে করা গড়ে তোলা শরীর এবং চেহারাটাকে অনেকগুন বেশী ভালোবাসি, সেদিন ও আচমকা রোড য়্যাক্সিডেন্ট করল । প্রচুর রক্তক্ষরণ হল । ডাক্তার বলল, দ্রুত রক্তের ব্যাবস্থা করুন ।ওর আর আমার রক্তের গ্রুপ একই, তবুও আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলাম, কোনো ব্লাড ব্যাংকে ঐ গ্রুপের রক্ত আছে কি না, কেননা আমি ততদিনে নিজেকে সবচে' ভালোবাসতে শিখেছি ।ভালোবাসার শরীর থেকে কে রক্ত ঝরাতে চায় বলুন?
Previous Post
Next Post
Related Posts